অবশ প্রজন্ম

সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি ,

সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।

আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে ,

আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে।

 

একবিংশ শতাব্দীর এই তৃতীয় দশকে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের বিখ্যাত এই চরণ বড্ড ঠুনকো হয়ে এসেছে। ঝাপসা হয়ে এসেছে দূর নক্ষত্রের মতো। নক্ষত্র শব্দটি যথার্থ একারণেই যে বিংশ শতাব্দীর সকল অর্জন বর্তমানে নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে এবং একই সাথে তা মিটিমিটি করে জ্বলছে এই প্রজন্মের মহাকাশে। বিংশ শতাব্দীর সময়কাল গণনা করা হয় ১৯০১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে শুরু করে ২০০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য, মহাকাশ, অস্ত্র, যুদ্ধ, মহামারী ইত্যাদির পাশাপাশি প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার ঘটে যায় এই শতাব্দীর শেষ দিন অব্দি। কোনো ধরনের সন্দেহ ছাড়াই এ কথা বলা যায় যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাসে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বিংশ শতাব্দীর গুরুত্বটা সব সময় একটু বেশিই। এ শতাব্দীতে আবিষ্কৃত হয়েছে এমন অনেক কিছু, যা মানুষের জীবনে এনে দিয়েছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আর এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যেসকল বিষয় আমরা অর্জন করেছি তার সবটাই যে মানব কল্যানের জন্য এসেছে এমনটা না। একটি নির্দিষ্ট কালে বা সময়ের মধ্যে জন্ম নেওয়া ও বেঁচে থাকা মানুষের সমষ্টিকে প্রজন্ম বলা হয় যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে 'জেনারেশন' (Generation)। বর্তমান প্রজন্ম নিয়ে কথা বলতে হলে আমাদেরকে ফিরতে হবে বিংশ শতাব্দীর সেসকল প্রজন্মের কাছে, নক্ষত্রের কাছে যারা প্রতিটা অর্জনকে মানব কল্যানে কাজে লাগিয়েছে।  


১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবরে তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের বড়লাট লর্ড কার্জনের আদেশে প্রথম বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় এবং ১৯১১ সালে প্রচণ্ড গণআন্দোলনের ফলশ্রুতিতে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়। দ্বিতীয়বার বঙ্গভঙ্গ হয় ১৯৪৭ সালে। আমরা ৫০এর দশকে উত্তাল এক প্রজন্মকে দেখতে পেলাম যারা ভাষার জন্য রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিলো। কোনো অন্যায় অনিয়মকে প্রশ্রয় দেয়নি তারা। মা, মাটি এবং ভাষার প্রতি তাদের এই ত্যাগ প্রকাশ পেয়েছে ৬০এর দশকে জাতীয়তাবাদী স্বাধিকার চেতনার ক্রমবিকাশে। ৭০এর শুরুটা ছিলো অনেক রোমাঞ্চকর, জাতীয়তাবাদী স্বাধিকার বিজয় বাঙ্গালী জাতীর সর্বোচ্চ বিজয়। একটি মহান প্রজন্মের হাত ধরে জন্ম নিলো বাংলাদেশ। অনেক উত্থান পতন। ৮০এর দশক পুরো সময়টা সদ্য স্বাধীন দেশ পুনর্গঠনে অবদান রাখা প্রজন্মকে দেখা গিয়েছে নির্ভিক এবং সাহসী পদপেক্ষপ নিতে, হারিয়েছে তবে মাথা উচু করে। ঠিক একই সময়ে বহির্বিশ্বে জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য, প্রযুক্তির স্রোত বয়ে চলছে এবং তার ধারা আমাদের প্রতিটা প্রজন্মকে ছুয়ে যাচ্ছে। একটি প্রজন্ম পূর্ববর্তি প্রজন্মের কাছ থেকে শিক্ষা অর্জন করে আর তারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে পরবর্তী প্রজন্মকে প্রবুদ্ধ করে। ৯০এর প্রজন্ম একটি স্বাধীন গোছালো দেশে স্বাচ্ছন্দে সময় অতিবাহিত করেছে। ৬০ দশকের ইন্টারনেটের ধারনা থেকে ৮৯’এ এসে তা দুনিয়া ব্যাপী ছড়িয়ে গেলো। রেডিও থেকে টিভি এবং তারই ধারাবাহিকতায় ৯৬ সালে দেশে প্রথম ইন্টারনেটের জন্য ভিস্যাট স্থাপন করা হয়। প্রযুক্তির রৈ রৈ শুরু হয়ে গেলো। প্রজন্ম তখন নব বিপ্লবের জাগরণে বিমোহিত !!

 

কাঁদা মাখা রাস্তায় যখন একটি একটি করে ইট বিছিয়ে খন্ডকালীন চলাচলের ব্যবস্থা করা হয় তখন অচেনা কোনো পথিক সে পথে পা বাঁড়ায় শুধুমাত্র বিশ্বাসের ওপরে ভিত্তি করে। সে আদৌ জানেনা  পরের ইট টার ওপরে পা পৌছাবে কিনা! ৯০ এর প্রজন্ম মিডিয়ার লাল নীল আলো এবং ৬০ এর দশকে কল্পিত বিশ্বগ্রাম বা গ্লোবাল ভিলেজের সাথে পরিচিত হতে চলেছে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে। যেগুলো সম্পর্কে তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম ততটাও অবগত ছিলো না। পরিবার, পরিজন, বন্ধু, আত্মীয়, খেলাধুলা, সাহিত্য, বিনোদন এবং একটি সুন্দর সমাজ এসে পড়লো একবিংশ শতাব্দীতে। খুব কম মানুষই পথ সৃষ্টি করে বাকি সবাই সেই পথ অনুসরন করে। শতাব্দীর প্রথম দশকে এই প্রজন্মের কাছে বিগত শতাব্দীর সব কিছুই কেমন যেনো পুরোনো লাগতে শুরু করলো যাকে বলে (ওল্ড মডেল)। আর তারই পরিপেক্ষিতে ঘটনাক্রমে তথাকথিত গ্লোবাল ভিলেজ বা বিশ্বগ্রামের আবির্ভাব ঘটলো ইন্টারনেটের আশির্বাদ প্রাপ্ত হয়ে। পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের কাছে জানা নেই যে বিশ্বগ্রামের নিয়ন্ত্রণ কাদের হাতে আর এর মধ্যে দিয়ে বর্তমান প্রজন্ম কি অর্জন করতে চলেছে। প্রজন্ম পা বাড়িয়ে দিলো এক অপার বিশ্বাসের ওপরে ভিত্তি করে। ২০০৪ সালে 'ফেস-মাশ' নামে জন্ম লাভ করা ফেইসবুক, ২০০৫ সালে জন্ম লাভ করা ইউটিউব এবং ২০০৬ সালে জন্ম লাভ করা টুইটার তখন আমাদের প্রজন্মের কাছে বড় পাওয়া। ঐ যে, এখন তো আমরা একই গ্রামে বাস করি “বিশ্বগ্রাম” । যে গ্রামের ভাষা এক, কথা এক, শব্দ এক, সংস্কৃতিও এক!!! পরিস্থিতি কখন কোন দিকে মোড় নেবে সে সম্পর্কে কেউ ভাবনা চিন্তা করেনি। পূর্ববর্তী প্রজন্মের কাছে এগুলো যেহেতু বোধগম্য নয় সেহেতু তারা আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বলতে যাবে কেন? পরিবারের কাছে সন্তান তখন “ সবাই এগিয়ে যাচ্ছে আমার সন্তান কেন পিছিয়ে থাকবে” অবস্থা। চলো ঢালাও ইংলিশ মিডিয়ামের দিকে ঝুকে পড়ি এবার, সময় হয়ে এলো। আহা! গ্রামের সকলের ভাষা যে এক। শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার আনা জরুরী সে কথা কারো মনে উদয় হওয়ার প্রয়োজন নেই তখনো, এখনো।  সমাজের কাছে তখন কম দামে যোগাযোগ এবং পণ্যের বিজ্ঞাপন সব থেকে আগে প্রয়োজন। রাষ্ট্র যেখানে বহুজাতিক চিন্তা ভাবনা করছে সেখানে আমাদের আর কিছুই করার থাকে না। আর সব থেকে বড় কথা কোথাও তো কোনো ঝামেলা নেই তো কেন এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে এতো। অথচ ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের ভেতর ….. বাদ থাক সে কথা, অনেক আগের পুরোনো কথা সে।

 

ভেতরে ভেতরে সারা দুনিয়ার মতো আমরা একই গ্রামের বাসিন্দা হলেও গ্রামের মোড়ল কিন্তু আমরা না। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম, সমাজ বা রাষ্ট্রের কাছে যার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই !! তাহলে মোট কথা দাড়ালো যে আদৌ জানিনা পরের ইট টার ওপরে পা পৌছাবে কিনা! বর্তমান প্রজন্ম সেই কাঁদায় পিছলে পড়া প্রজন্ম। আমরা বাস করছি সভ্যতার চরম সীমারেখায়, সভ্যতার কানুন আমাদেরকে অমরত্ব ছাড়া সব দিয়েছে । আমরা ইচ্ছা করলে সহজেই দুনিয়া ধ্বংস করে দিতে পারি বারংবার । প্রমাণ চাই আপনার? ১) ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ১,২৯,০০০ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছিল। তখন গত শতাব্দীর ফেনসিডিলের জায়গাটা খুব ভালোমতো ধরে নিয়েছে এই নতুন মাদক। ২) ২০১২ সালে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে ২৬ কেজি হিরোইনের চালান ধরা পরে। ৩) ২০১৫ সালের মে মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে তরল কোকেনের চালান ধরা পড়ে। মোড়লদের মতামত ছিলো বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মাদক চোরাকারবারের অন্যতম প্রধান রুট। তখনো এসকল ঘটনার সাথে সরাসরি কোনো ব্যক্তি কিংবা সংঘকে দায়ী করার মতো পরিবেশ বা সাহস কারও হয়নি। সাম্প্রতিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের মৃত্যু তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেলো সে এলএসডি সেবন করে আত্মহত্যা করেছে। ডিএনসি বলছে, এলএসডি নতুন কোনো মাদক নয়। বাংলাদেশে এই মাদকের ব্যবহারে বহু বছর আগেই শুরু হয়েছে। তবে এর ব্যাপক বিস্তার হয়নি। কেননা, এই মাদকের দাম বেশি এবং এটি ইউরোপের দেশ থেকে বাংলাদেশে এসেছে। আসবে না কেন !! আসতে তো বাধ্য, আমরা তো একই গ্রামে বসবাস করি। মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে পাঁচটি সংস্থার ১২ বছরের (২০০৯-২০২০) উদ্ধারকৃত মাদকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে যুগান্তর পত্রিকা। সংস্থাগুলো হলো-মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি), র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) বাংলাদেশ কোস্টগার্ড। পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া ২৫ ধরনের উল্লেখযোগ্য মাদকের মধ্যে এই পাঁচ সংস্থা সবচেয়ে বেশি উদ্ধার করে ধরনের মাদক। এগুলো হলো-ইয়াবা, হেরোইন, কোকেন, আফিম, গাঁজা, ফেনসিডিল, বিদেশি মদ, বিয়ার ইঞ্জেকটিং ড্রাগ। একটি প্রজন্মকে শেষ করতে আর কি কি লাগে ?? অবাক করা বিষয় হচ্ছে, সেবনকারীরা অর্থ জোগাড়ে একসময়ে মাদক ব্যবসা করছে অনলাইনে। এভাবে ক্রমেই এর চাহিদা বাড়ছে বিস্তার হচ্ছে। মাদকাসক্তের সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের সব দেশের মধ্যে সপ্তম৷ মাদকাসক্তরা মাদকদ্রব্য কেনায় বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিনোদন মাধ্যম হিসেবে বর্তমান প্রজন্মের হাতে মোড়ল সম্প্রদায় যে সকল মরনাস্ত্র তুলে দিয়েছে তা একটু চোখ মেললেই দেখতে পাওয়া যায়। বলা হচ্ছে সুস্থ বিনোদনের মাধ্যমে মাদক থেকে দূরে থাকো আর টিক টক, লাইকি, বিগো, ফেইসবুক বিনোদন এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যেম হিসেবে ব্যবহার করে ঘটে যাচ্ছে একটার পর একটা অপরাধ- অপকর্ম। অপসংস্কৃতির ভেতরে কালক্রমে হারিয়ে গেলো আমাদের নিজস্বতা এবং মূল্যবোধ!! ফ্রি ফায়ার, পাবজি এবং এ জাতীয় গেইমস এর আড়ালে হাজার হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে মোড়লদের পকেটে আর পড়ে থাকছে কাতর, ক্লান্ত, বিষাদগ্রস্ত একটা প্রজন্ম!! প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং তা রুখে ধরার জন্য যে আইন করা হচ্ছে সেই আইনের প্যাচে পড়ে রাঘব বোয়াল থাকছে ধরা ছোয়ার বাইরে। ভুক্তভুগি হচ্ছে অবশ এই প্রজন্মই। যাদের ব্যাথা নেই, অনুভূতি নেই, যন্ত্রণা নেই আর নেই কোনো বোধশক্তি!!

 

একটি সুস্থ সবল স্বাধীন দেশ খুব অগোচরে পরাধীন হয়ে গেলো কিন্তু কেউ বুঝতেই পারলো না। এত কিছু সত্ত্বেও আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতা আমাদের শুধু পিছনে নিয়ে যাচ্ছে, বানরের তৈলাক্ত বাশের অঙ্কের মত যতটুকু না উপরে উঠছি- আমাদের মানবিকতা তার থেকে নিচে নেমে যাচ্ছে  এবং শুধু নামছেই। আমিও হাটছি পায়ে পায়ে কিন্তু কখন কোন পায়ে তাকিয়ে কোন দিকে চলছি হেটে তা দেখার ফুসরত কোথায়! হেটে চলেছি এটাই তো বড় কথা। পরিবার, সমাজ, সমাজপতি,  গবেষক, চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টির ভেতরে থেকে একবিংশ শতাব্দীর তরুণ প্রজন্ম একটু একটু করে অবশ হতে আরম্ভ করলো। সমস্ত ধরণের দুর্দশার গর্বিত মালিক যেনো এই প্রজন্ম। আর সবাই তাদের দিকে আঙ্গুল তুলে বলা শুরু করলো “ এদেরকে দিয়ে কিচ্ছুউউ হবে না” ।      

 

ভাইবোন সকলেরে যেন ভালোবাসি ,

এক সাথে থাকি যেন সবে মিলেমিশি।

 ভালো ছেলেদের সাথে মিশে করি খেলা ,

পাঠের সময় যেন নাহি করি হেলা।

 সুখী যেন নাহি হই আর কারো দুখে ,

মিছে কথা কভু যেন নাহি আসে মুখে।

সাবধানে যেন লোভ সামলিয়ে থাকি ,

 কিছুতে কাহারে যেন নাহি দেই ফাঁকি।

ঝগড়া না করি যেন কভু কারো সনে ,

সকালে উঠিয়া এই বলি মনে মনে।

 

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

একতারা ভাস্কর্য, একতারা চত্বর হরিণাকুন্ডু

রূপ; বহুরূপ !

সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।