খাঁচায় বন্দী সময়ের বোকা বাক্স, ভগ্ন ঘন্টার কাটা !
প্রথম কয়েকটা দিন ঘণ্টার হিসাব করতাম। সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠার পর কোনো কোলাহল শুনতে পেতাম না। ঘড়ির কাটায় টিক-টিক করে দিন গড়িয়ে থমথমে দুপুর আসে আর গোধূলি শেষে ঝুপ করে নেমে আসে অন্ধকার, ঘোর কালো। আমরা কেন যে সেকেন্ড মিনিট আর ঘন্টার কাটার টিকটিক শব্দের মধ্যে নিজেদের জীবনকে বন্দী করেছিলাম! এত বড় ক্ষতি করলাম এভাবে নিজেদের! এসব কথা ভেবে ঘন্টার হিসেবটা ভুলে গেলাম। কি দরকার সময়ের ফ্রেমের মধ্যে আটকে থাকা। আটকে থাকার কথাটা যখন আসলো তখন খোলাখুলিভাবে বলাই ভালো। পৃথিবীর বুক চিরে বেঁচে থাকার উৎস পেয়েও শান্তি পেলাম না, মাটি থেকে তৈরি মানুষ হয়ে আমরা মাটি পুড়িয়ে বড় বড় অট্টালিকা গড়ার প্রতিযোগিতা শুরু করলাম। একে অপরকে হত্যা করার জন্য তৈরি করলাম ধ্বংসাত্মক মারণাস্ত্র। পৃথিবীর শ্বাসরোধ করে করে গাছগুলো কেটে নেয়ার মহোৎসবের আয়োজন করলাম আর পোড়ামাটির শহরটাকে সাজাতে লাগলাম বর্ণিল সাজে। এ যেন নিজেরাই নিজেদের জন্য জেলখানা তৈরীর হুড়োহুড়ি। বুক চিরে মাটি উঠিয়েও শান্তি পেলাম না, মুহূর্তে সবকিছুর শেষ দেখার লোভ সামলাতে না পেরে চেড়া বুকের আরও গভীর থেকে তুলে আনলাম নানা সব উপকরণ। ঐ যে, শেষ দেখার লোভ! তুলে আনা বিক্ষিপ্ত জিনিসগুলো দিয়ে শক্তপোক্ত করলাম পোড়ামাটির কাঠামোকে। চলার জন্য নিয়ে আসলাম অনন্ত অসীম গতি, কয়েক মুহূর্তে পৃথিবী চষে ফেলার উন্মাদনা! এই নিয়ে খুনোখুনি চলছিল বেশ, শতাব্দীর পর শতাব্দী। মানুষকে ঘৃণা করলাম আর ভুলে গেলাম নিজেও মানুষ! খুব কষ্টে, ধুঁকে ধুঁকে পৃথিবী চলছিল। না, নিজস্ব গতিতে না মানুষের তৈরি ঘণ্টার কাটায় টিক টিক করে।
এদিকে রঙিন বিষের ছটাকে রাঙিয়ে দিতে ব্যস্ত আমরা মানুষ রাত নামলেই চুপ করে গিয়ে লুকিয়ে থাকি নিজের গড়া জেলখানাতে আর অল্প আলো ফুটলেই নেমে পড়ি ধ্বংসাত্মক লীলাখেলায়। মৃত্যুতে কি পৈশাচিক আনন্দ! চলছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। গলা টিপে মারার চেষ্টা চলছে পৃথিবীকে, শরীরের উপর ভাসিয়ে রেখেছে বর্নিল রঙ্গমঞ্চটাকে অথচ….!! আমরা থামি না, প্রহরগুনি কবে পালিয়ে যাবে বিচ্ছিরি ধরণী থেকে। কবে নতুন একটা আবাসস্থল তৈরি হবে আর সেখানে গিয়ে ফিরেও তাকাবো না এদিকে। আরো ভাবি সেখানে কি অক্সিজেন থাকবে? আর এদিকে গাছকেটে বিষাক্ত পদার্থ দিয়ে বিষিয়ে তুলছে পৃথিবীকে!! আচ্ছা, সেখানে কি চাষাবাদ হবে? আমাদের কি ক্ষুধা লাগবে? আর পৃথিবীর বুকে থেকে উৎপাদিত সম্পদ নষ্ট করছি। খুন-গুম, ধর্ষণ, রাহাজানি, নৈরাজ্যের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছি হাসতে হাসতে;অসুস্থ উৎসব চলছে- শতাব্দীর পর শতাব্দী।
মানুষ হিসেবে জন্ম নেয়ার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমরা পৃ্থিবীর কাছ থেকে শুধু আহরণ করি, ভোগ করি কিন্তু একটি বারের জন্যও কি ভেবে দেখিনা আমাদের কাছ থেকেও পৃ্থিবীর কিছু পাওনা আছে, কিছু অধিকার আছে!! আমার উচিৎ, ঠিক আমার না; আমাদের উচিৎ, যে পৃথিবী থেকে জন্মের স্বাদ লাভ করছি, যে পৃথিবী থেকে বাঁচার সকল উপাদান পাচ্ছি, যে পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি সেই পৃথিবীর জন্য কিছু করা। নিঃস্বার্থভাবে, অল্প হোক তবুও সেটা মন থেকে- একদম ভেতর থেকে, মনুষ্যত্বের জায়গা থেকে। একটি পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে, একটি মাতৃভূমিতে দাঁড়িয়ে কিংবা ঠিক যে মাটিটুকুর উপরে দাঁড়িয়ে আছি সেইটুকু মাটির জন্য কিছু করা। আমার মৃত্যুর ঠিক কয়েক মুহুর্তে যে শিশুটি জন্ম নেবে তার জন্য কি একটি সুন্দর পৃথিবী রেখে যেতে চাই আমি? ভালোবাসা মূলত দুটি পর্যায়ে বিভক্ত: একটি হলো স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির প্রেম, অন্যটি হলো সৃষ্টির সঙ্গে সৃষ্টির প্রেম। স্রষ্টা নিজেও তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসেন এবং সৃষ্টির সেরা জীবের জন্য পৃথিবীকে সুশোভিত করেছেন। এজন্য সকল মানুষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতা না পেলে জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। ঠিক এ কারণেই মানুষ হিসাবে আমাদের উপর দায়িত্ব পড়ে, নিজ অধিকার অর্জনের চেষ্টার পাশাপাশি সে সব পর্যায়ের মানুষগুলোকে ভালবাসা, সহমর্মিতা ও সহযোগিতা দেয়া। এ ভাবে পরস্পরে দায়িত্ব পালন করলেই সমাজে শান্তি, উন্নতি ও সমৃদ্ধি আসে। সমাজ ও দেশের প্রত্যেক মানুষের জীবন হয় তখন সুখময়।
একটা সময় নিজেকে খুব অকৃতজ্ঞ মনে হতে লাগল। ছি!! ধিক্কার জানাচ্ছি বারবার। বন্দী মানুষ গুলো এক এক করে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিচ্ছে। যেন মৃত্যুর মহাউৎসব! পালিয়ে যাওয়ার জায়গা খুঁজে পাওয়ার আগেই মাটি থেকে উঠে আসা মানুষ মিশে যাচ্ছে মাটিতেই! কোনো কোলাহল নেই কোথাও। শুনলাম পৃথিবী নাকি ইদানীং শ্বাস নিচ্ছে বুক ভরে! আর সময় বন্দী হয়ে আছে খাঁচার ভেতরে, থেমে গিয়েছে সেকেন্ড-মিনিটের কাটা !! মানুষ আজ মৃত্যুর প্রহর গুনছে আর শুনছে মৃত্যুর মিছিল আজ হাজার থেকে লক্ষ ছাড়িয়েছে! মানুষ এখন লাশ গণনায় ব্যস্ত। ইচ্ছে না হলেও গুনতে হচ্ছে। শত চেষ্টা করেও কেউ বিরত থাকতে পারছে না; এই ব্যাথার শহরে প্রতিটা মৃত্যুর ব্যাথা পৃথিবীর প্রতিটা মানুষকে ভোগ করতে হচ্ছে!! পাখিরা ডানা ঝাপটে উড়ে চলেছে দূর ঐ আকাশের কোনটাতে আজ তারা মুক্ত,স্বাধীন… মাটির প্রতি মমতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং দায়বদ্ধতার কথা মনে করার জন্য ঘন্টার কাঁটা আজকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে নাঃ একদিন হঠাৎ কাক ডাকা ভোরে ভেঙে পড়ে থাকবে মানুষের তৈরী বন্দী খাচার উঠানে। সেদিন থতমত খেয়ে থেমে যাবে সেকেন্ড এবং মিনিটের কাটা দুটি! যে মানুষ মানুষকে ঘৃণা করতো, যে মানুষ মানুষকে হত্যা করতো, যে মানুষ মানুষের সাথে পেরে না উঠে পৃথিবীকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করত; সেই মানুষ বাঁচার জন্য কাকুতি-মিনতি করছে। পৃথিবীর প্রতি যে দায়বদ্ধতা; সেই দায়বদ্ধতা এবং কর্তব্যবোধ পূরণ করার জন্য একটু সময় পাওয়া ভার!! মৃত্যুর মিছিল আর কত বাকি? কাছের মানুষকে হঠাৎ করেই খুঁজতে আরম্ভ করলাম। কিন্তু কি হলো? আজ কাছাকাছি যাওয়ার নিয়ম নেই,পৃথিবী তার অধিকার মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে চিৎকার করে হাসছে!! কাছের মানুষকে দূরে রাখলেই আজ তারা বেশি নিরাপদ। জেলখানা থেকে শেষবারের মতো বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছে হাজারো প্রাণঃ পরক্ষনে যুক্ত হচ্ছে মিছিলের নতুন একটি কাতারে। আটকে রাখতে পারছে না কোনো বাঁধন, কো্নো সম্পর্ক আর কোনো মায়া। বেঁচে থাকার তীব্র আকুতি আজ; আটকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা পৃথিবীতে।
@খাঁচায় বন্দী সময়ের বোকা বাক্স, ভগ্ন ঘন্টার কাটা !
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন