এবারের শীত এবং একটি লাল টিপের গল্প

মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। গত দুই ঘন্টা ধরে একটানা ... ক্ষিলখেত থেকে উবারে চেপে গাবতলী এসে নেমেছি আধা ঘন্টারও আগে। বৃষ্টি সবসময়ই খুব টানে আমাকে আর তার চূড়ান্ত প্রতিফলন ঘটে যখন ইচ্ছেমতো ভিজতে পারি। কিন্তু আজ বড্ড আফসোস হচ্ছে! পূর্বাশা কাউন্টারের সামনে থেকে হাটা শুরু করলাম, উদ্দেশ্য ধোয়া ওঠা এক কাপ চা । এই বৃষ্টিটা হচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা, আর আজকের বৃষ্টি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অনেক দূরের একটি শহরে। আমার শহর ঝিনাইদহে... ধোয়া ওঠা চায়ের কাপ আর সিগারেট নিয়ে কাউন্টারের সামনে এসে দাড়ালাম, বাস ছাড়বে আরো ১৫ মিনিট পর।

ঝিনাইদহে শীত মানে কামেনী ফুলের সুবাস! আমাদের পারিবারিক গোরস্থানের প্রাচীন কামেনী গাছটি আমাকে ডাকছে। যখন আমি খুব ছোট তখন দাদা আমাকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, তারপর থেকেই আমাদের প্রেম। দাদা আজ ১৪ বছর সেই কামেনী গাছের নিচে গভীর নিদ্রায় শুয়ে আছে। টানটা বোধহয় সেইজন্যই একটু বেশী। আমার শহরে শীতের নানা রকমের সংজ্ঞা আছে , সেখানে শীত মানে সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরের শিউলি আর জবা ফুলের ঘ্রাণ। মিরু কাকার ডাক শুনে ভাবনার ভেতর থেকে বের হলাম। মিরু কাকা হচ্ছে পূর্বাশা পরিবহনের ড্রাইভার এবং আমার খুব কাছের একজন প্রিয় মানুষ । “বিটা গাড়িতে ওঠো, ছাড়বো” । জানালার পাশে বি-৪ সিট বুক দেওয়া কিন্তু উঠেই দেখি সেই সিটে একটি মেয়ে ঘুমিয়ে আছে । কি একটা কাজ ! জেগে থাকলে না হয় বলতাম ওটা আমার সিট কিন্তু ঘুমন্ত মানুষকে ডেকে সিট ছাড়তে বলাটা কেমন হয়ে যায় । মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল ... এমনটা এই প্রথম না এর আগেও অনেকবার হয়েছে কিন্তু এইবারই ব্যতিক্রম ! সুপারভাইজার কে বললে বলা যায় কিন্তু ইচ্ছে করল না । কি আর করার পাশের সিটেই বসলাম । বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, ইলশেগুঁড়ি ।

কিছুক্ষণ পর দেখলাম ঘুম থেকে উঠেছে কিনা, উঠলে সিট বদল করে নেব কিন্তু কপাল ... ৩০ মিনিট, ৪৫ মিনিট এবং ১ ঘন্টার ভেতর তিন তিনবার একটা মুখের দিকে তাকানো আমার একদম উচিৎ হলো না ! ঘুমন্ত মুখ , জানালা থেকে বাতাস এসে চুলগুলো এলোমেলো করে দেওয়ার চেষ্টা করছে আর কপালে একটা লাল টিপ। কি একটা যন্ত্রণা, সিট নিলাম জানালার পাশে আর বসে বসে সেই সিট পাহারা দিতে হচ্ছে । ঘুম থেকে উঠুক আর না উঠুক ওদিকে আর তাকানো যাবে না এই ভেবে কানে হেডফোনটা গুজে দিলাম । প্রচন্ড ক্লান্ত, হালকা তন্দ্রা আর হেডফোনে অর্নবের কাঠগোলাপ ... ঝিনাইদহে শীত মানে চেনা রাস্তার ওপর ছড়িয়ে থাকা কাঠ গোলাপের সাদার মায়া । বাস ছুটে চলছে সেই শহরের উদ্দেশ্যে আর আমার হৃদয়টা অনেক আগেই পৌছে গেছে সেখানে ! এর মাঝেই পাশের সিটের মেয়েটা একটু নড়েচড়ে উঠলো ভাবলাম এইবার বুঝি সুযোগটা পাব কিন্তু না, এতো ঘুম মানুষ কিভাবে ঘুমায় নাকি ইচ্ছে করেই এমন করে সিট দখল করে আছে !!! আবার একবার তাকালাম, নাহ সত্যি সত্যিই ঘুমচ্ছে ... অদ্ভুত সেই ঘুম । অন্য কোথাও গিয়ে বসবো সেই উপায় নেই সব বুক ... উঠে গিয়ে সুপারভাইজারের সাথে একটা সিগারেট টেনে আসলাম আর মিরু কাকার কাছে কাহীনিটা বললাম । ফিরে এসে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিলাম হেডফোনে তখন রিকলের "ঘুম" বেজে চলেছে ...

"ঘুম ঘুম দুচোখে তোমার,
কাহার মোহ কাহার মায়া?
অনাগত ইচ্ছে গুলো,
নিয়ম ভেঙে বাঁধন হারা ।
আগলে রাখা মনের ভেতর
নতুন কিছু আশা,
আড়াল করে, মনের ভুলে ... হাসা "

ঝিনাইদহে শীত মানে, গীতাঞ্জলি সড়কে খুব ভোরে চায়ের দোকানের ধোয়া ওঠা লেবু চা অথবা নবগঙ্গার ধারে খেলার মাঠে ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলোর ফুটবল খেলা । হঠাৎ একটা ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাস মাগুরার ভেতর দিয়ে ছুটে চলছে ... পাশের সিট খালি পড়ে আছে তখন আর তার ঠিক এক কোনাতে লেগে আছে একটা লাল টিপ ! সেই লাল টিপটা, হয়তো ঘুমের মধ্যে কপালে হাত লেগে পড়ে যেতে পারে অথবা ... । উঠিয়ে নিলাম হাতে, কতো যত্নে লাগানো টিপ অবহেলায় খুলে পড়ে যায় আর কার কপালের টিপ কখন যে কার হয়ে যায় !!

(ছবিঃ কার ছবি জানিনা 🙄)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

একতারা ভাস্কর্য, একতারা চত্বর হরিণাকুন্ডু

রূপ; বহুরূপ !

সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।