শুধুমাত্র একটা বাড়ি নয়, এর পেছনে থাকা প্রেম, ত্যাগ এবং একজন মুরারীর কথা !
অনেক দিন ধরে ভাবছিলাম একটা গল্প বলব (সংক্ষেপে) । ঠিক গল্প বললে ভুল হবে, এটাকে জবানবন্দি বলা উচিৎ ! হ্যা, আমার দাদা মৃত গোলাম মোস্তফা মিয়ার কাছ থেকে দীর্ঘ ৫-৬ বছর যাবৎ আমি এই গল্পটা শুনেছি শত শত বার । শুধুমাত্র একটা বাড়ি নয়, এর পেছনে থাকা প্রেম, ত্যাগ এবং একজন মুরারীর কথা ! শুনেছি কিভাবে বাড়িটির নাম মিয়ার দালান হলো এবং কিভাবে মিয়া পাড়া হলো । এই সঠিক ইতিহাস অনেকের অজানা আর যারা যতটুকু যানে তা সম্পূর্ন ভুল !! ১৯৫ বছর আগে ফিরে যাব তবে তার আগে "মিয়ার দালান" নামটার সাথে পরিচয় আমাদের হোক ! ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা থানার দিগনগর গ্রামের ইমান আলী মিয়ার চার ছেলে ১) গোলাম মোস্তফা মিয়া ২) ইসমাইল মিয়া ৩) বদর মিয়া ৪) হায়দার মিয়া আজ থেকে ৫৬ বছর আগে (১৯৬২) সালে ঝিনাইদহ শহরে এসে জানতে পারেন পাশের গ্রামে ( সে সময়ের পোড়াহাটি ইউনিয়নের ১২২ নাম্বার মৌজায় ) একটি পুরোনো বাড়ি বিক্রি হবে । ঝিনাইদহ সদর শহর থেকে এই গ্রামের দুরুত্ব ২.৫ কি: মি: , নবগঙ্গা নদীর উত্তর ধারে দাড়িয়ে থাকা দোতলা বাড়িটা ৫৬ বছর আগে দেখতে অসম্ভব সুন্দর ছিল !!! চুন-সুড়কির সঙ্গে ইটের গাঁথুনিতে তৈরি । দেয়াল ২৫ ইঞ্চি পুরু । উত্তর-দক্ষিণে দৈর্ঘ্য প্রায় ৮২ ফুট । পূর্ব-পশ্চিমে এর প্রস্তর প্রায় ৬৬ ফুট। ছোট বড় ১৬টি কক্ষ । দ্বিতীয় তলার ছাদের ওপর একটি চিলেকোঠা !! মনোরম এই পরিবেশ দেখে চার ভাই বাড়িটি কিনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন । হিরেডাঙ্গার আব্দুল জব্বার এবং আব্দুল আজিজের নিকট থেকে বাড়িটি কিনে নিতে তাদের খুব বেশি দিন লাগল না ! সেলিম চৌধুরীর এই বাড়িটি তখনো পর্যন্ত "চৌধুরী" বাড়ি নামেই পরিচত ছিল । দিগনগরের ৪ "মিয়া" বাড়িটিতে আসার পর সেটা আর রইল না । শহর থেকে কেউ গ্রামে আসলে বলত মিয়া পাড়ার কথা আর রাস্তা থেকে এক নজরে দেখা যেত " মিয়ার দালান" !!!! এটা হলো দিগনগরের মিয়াদের বাড়ি "মিয়া বাড়ি" । এবার যাচ্ছি ১২২৯ বঙ্গাব্দে, এই বাড়ির সঠিক ইতিহাস জানতে আমার দাদা গোলাম মোস্তফা মিয়া অনেক সময় অতিক্রান্ত করেছিলেন । কোলকাতার জমিদার পুত্র সেলিম চৌধুরীর অনেক কথা জানতে পেরেছি তার কাছ থেকে । সেলিম চৌধুরী মুরারী নামে একটা হিন্দু মেয়ের প্রেমে পরে এবং বাবা মায়ের অসম্মতিতেই তাকে বিয়ে করে । সে সময়ে সেলিম চৌধুরীর বাবা ধর্মের কাছে নিজের বংশের মান ধরে রাখার জন্য ছেলেকে ত্যাজ্য পুত্র করে এবং রীতি অনুযায়ী ছেলের প্রাপ্য সম্পত্তি বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয় !!! চৌধুরীর দাদী ছিলেন একজন জ্ঞানি ব্যক্তি, তার পরামর্শ অনুযায়ী সেলিম চৌধুরী নদীপথে লোক লস্কর নিয়ে যাত্রা শুরু করে মুরারীকে সঙ্গে নিয়ে । অনেক পথ আসার পর নবগঙ্গার উত্তর ধারে ( বর্তমানে বাড়িটি যেখানে অবস্থান করছে ) পানির মাঝে বাড়ি নির্মানের সিদ্ধান্ত নেন !! সঙ্গে ছিলেন কোলকাতার নামী রাজ মিস্ত্রী রাজ চন্দ্র রাজ এবং তার দল ! ১২২৯ - ১২৩৬ অর্থাৎ ৭ বছর কেটে যায় বাড়িটির কাঠামো দাড় করাতে । মূল ফটকের ওপরে লিখে দিল "‘শ্রী শ্রী রাম, মুরারীদহ গ্রাম ধাম, বিবি আশরাফুন্নেসা নাম, কি কহিব হুরের বাথান। ইন্দ্রের অমরাপুরী নবগঙ্গার উত্তর ধার, ৭৫,০০০ টাকা দিয়ে করিলাম নির্মাণ। এদেশে কাহারও সাধ্য বাধিয়া নদীর অঙ্গ জলমাঝে কমল সমান। কলিকাতার রাজ চন্দ্র রাজ, ১২২৯ সালে শুরু করি কাজ, ১২৩৬ সালে সমাপ্ত দালান।‘ মুরারী ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে !! নতুন নাম হয় "আশরাফুন্নেসা" আর তার পূর্বের নাম অনুসারে গ্রামের নামকরণ হয় "মুরারীদহ" !! বাড়িটি নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছিল সে সময়কার ৭৫,০০০ টাকা !!! আর নকশাগুলো বাইরে থেকে তৈরী করে আনা হয়। নির্মাণে কোনো লোহার ব্যবহার নেই আছে শুধুমাত্র শাল কাঠের ব্যবহার। যাইহোক চৌধুরীর দাদী চলে আসল মুরারীদহে । চৌধুরীর কোনো সন্তান ছিল না !! দাদী মারা যাওয়ার পর বাড়ির পাশে তাকে কবর দেওয়া হয় " । চৌধুরী মারা যায় তার অনেক পরে , তখনো মুরারী বেচে আছে ... পরবর্তিতে তার কি হয়েছিল যানা যায়নি ... পরিত্যাক্ত বাড়িটি ঢেকে যায় গাছ গাছড়ার আড়ালে !!! তার অনেক বছর পর বাড়িটি নিলামে কিনে নেন আব্দুল জব্বার এবং আব্দুল আজিজ । ভয়ে কিংবা যেকোনো কারনেই হোক তারা বাড়িটিতে বাস করতে পারলেন না । আমি এ বাড়িতে থাকতে পারিনি কারন আমি যখন বোঝা শিখেছি তখন বাড়ি ছেড়ে সবাই বাইরে চলে এসেছে । মাঝে মাঝে দাদার কাছে থেকে গল্প শুনে দোতলার ঝুল বারান্দায় গিয়ে বসতাম .... রাতে আব্বুর সাথে লুকোচরি খেলতে গেলে আব্বুকে পাওয়া যেত না ! ছাদে গিয়া বসে থাকত !! ভয়ে কেউ বাড়ির সামনে যাওয়ার সাহস পেতাম না । বাড়ির সামনে গিয়ে আব্বুকে ডাকতাম । একরাত থেকেছি বটে তবে একা নয় !! সাথে ছিল শিহাব, নাইমুর মামা, শাহীন মামা, সৌরভ মামা, ইমন, আরব সহ অনেকে, সারা রাত জেগে ছিলাম চিলেকোঠার ছাদে !!! কত রহস্য সেই রাতে আর কত ঘটনা ঘটেছিল তা আর নাইবা বললাম !!! তবে একবার শুনেছিলাম দাদা ডাকছে , মোহাম্মদ আলী মিষ্টি মিয়া বলে কয়েক বার !!!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন